তিন ধরনের মোবাইল ফোন বন্ধ করতে যাচ্ছে সরকার
বর্তমান যুগে মোবাইল ফোন মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য অংশ। যোগাযোগ, শিক্ষা, ব্যবসা ও বিনোদন—সবই এখন ছোট একটি ডিভাইসের মাধ্যমে সম্ভব। তবে প্রযুক্তির দ্রুত বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন অনিয়ম, অপরাধ এবং অবৈধ উপায়ে আমদানি করা ফোনের ব্যবহারও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই কারণে সরকার মোবাইল ফোন খাতে শৃঙ্খলা এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করতে তিন ধরণের মোবাইল ফোন বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে বিভিন্ন মাধ্যমে আলোচনা চলছে। এর উদ্দেশ্য শুধুমাত্র মানুষকে সীমাবদ্ধ করা নয়; বরং প্রযুক্তি ব্যবহারে নিরাপত্তা, মান নিয়ন্ত্রণ এবং বৈধতার ভিত্তি আরও শক্ত করা।
প্রথমত, সরকার যেসব ফোন বন্ধ করতে পারে তার মধ্যে অন্যতম হলো অবৈধভাবে আমদানি করা বা “স্মাগলড” ফোন। বাংলাদেশের বাজারে এখনো বিপুল সংখ্যক ফোন ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে দেশে প্রবেশ করে। এসব ফোনে কোনো রকম নিবন্ধন থাকে না, ফলে মালিকের পরিচয় শনাক্ত করা কঠিন হয়। অপরাধী চক্র এসব ফোন ব্যবহার করে প্রতারণা, চাঁদাবাজি, সাইবার অপরাধসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালায়। তাই বৈধ আমদানি ও শুল্ক আদায় নিশ্চিত করতে অবৈধ ফোন নিষিদ্ধ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
দ্বিতীয়ত, নিয়মিতিকরণবিহীন বা ভেজাল আইএমইআই নম্বরযুক্ত ফোন বন্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে। আইএমইআই একটি মোবাইলের পরিচয় নম্বর, যা দেশের নেটওয়ার্কে নিবন্ধিত থাকতে হয়। কিন্তু অনেক সস্তা বা নকল ফোনে একই আইএমইআই নম্বর কপি করা থাকে, ফলে শত শত ফোনে একই নম্বর পাওয়া যায়। এতে মোবাইল ট্র্যাকিং ব্যাহত হয় এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজ কঠিন হয়ে পড়ে। এছাড়া এসব ফোনে রেডিয়েশনসহ নানা প্রযুক্তিগত ত্রুটি থাকে, যা ব্যবহারকারীর স্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে।
তৃতীয়ত, নিরাপত্তাহীন ও স্ট্যান্ডার্ডবিহীন ফিচার ফোন বা স্মার্টফোন, যেগুলো আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পূরণ করে না, সেগুলোও নিষিদ্ধের আওতায় যেতে পারে। বাজারে অনেক কমদামি ফোন পাওয়া যায় যেগুলোর ব্যাটারি বিস্ফোরণের ঝুঁকি, নেটওয়ার্ক বিভ্রাট বা নিরাপত্তা সেটিংস দুর্বল থাকে। ব্যবহারকারী এসব ঝুঁকি সম্পর্কে অজ্ঞ থাকায় বড় ধরনের দুর্ঘটনার সম্ভাবনা তৈরি হয়। সরকার যদি এমন ফোন বন্ধ করে দেয়, তাহলে মানসম্পন্ন পণ্য ব্যবহারের প্রবণতা বাড়বে এবং প্রযুক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সহজ হবে।
এই তিন ধরনের ফোন নিষিদ্ধ হলে সাময়িক অসুবিধা তৈরি হলেও দীর্ঘমেয়াদে এর সুফল অনেক। অবৈধ ফোন বন্ধ হলে সরকারি রাজস্ব বাড়বে, বাজারে প্রতিযোগিতা হবে সুষ্ঠু, এবং ভোক্তারা আসল পণ্যের নিশ্চয়তা পাবে। ভেজাল আইএমইআই বন্ধ হলে মোবাইল ট্র্যাকিং সহজ হবে এবং অপরাধ কমবে। মাননিয়ন্ত্রণহীন ফোন বন্ধ হলে ব্যবহারকারীরা আরও নিরাপদ প্রযুক্তি ব্যবহার করতে উৎসাহিত হবে। এতে দেশের টেলিকম খাতে স্বচ্ছতা ও নিরাপত্তা দুটিই বৃদ্ধি পাবে।
তবে সরকার যদি এমন উদ্যোগ গ্রহণ করে, তাহলে সাধারণ মানুষের জন্য সচেতনতা কার্যক্রম চালানো জরুরি। নিবন্ধনহীন ফোন কীভাবে যাচাই করতে হয়, কোন ফোনগুলো বৈধ, কোথায় অভিযোগ জানাতে হয়—এগুলো জানিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি যাদের কাছে আগে থেকেই অবৈধ বা অজানা উৎসের ফোন আছে, তাদের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা দিয়ে ফোন নিবন্ধনের সুযোগ দেওয়া যেতে পারে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, “তিন ধরনের মোবাইল ফোন বন্ধ করতে যাচ্ছে সরকার”—এটি মূলত প্রযুক্তি সেক্টরকে আরও সুশৃঙ্খল, নিরাপদ এবং বৈধ কাঠামোর মধ্যে আনার একটি উদ্যোগ। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন বাজারে নকল ও অবৈধ ফোনের প্রবেশ কমবে, অন্যদিকে ব্যবহারকারীর নিরাপত্তা বৃদ্ধি পাবে। উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর সমাজ গঠনে এমন সিদ্ধান্ত সময়োপযোগী এবং ভবিষ্যত-বান্ধব।
শেষ কথা
মোবাইল ফোন আমাদের আধুনিক জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি। তবে প্রযুক্তির সুবিধার পাশাপাশি নিরাপত্তা, আইনশৃঙ্খলা ও মান বজায় রাখাও সমান জরুরি। তাই সরকার যদি অবৈধ, নকল আইএমইআইযুক্ত এবং মানহীন মোবাইল ফোন বন্ধ করার উদ্যোগ নেয়, তা মূলত দেশের টেলিকম খাতকে সুরক্ষিত ও স্বচ্ছ করার লক্ষ্যেই নেওয়া হবে। এতে ব্যবহারকারী যেমন নিরাপদ থাকবেন, তেমনি বাজারে বৈধ পণ্য ব্যবহারের প্রবণতাও বাড়বে। তাই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে সচেতনতা বাড়ানোই হবে সময়ের দাবি।
